Skip to main content

ডিটেকটিভ এন্ড মিস লিলি | প্রথম পর্ব | Detective and Miss Lily | Episode 1


  মোঃ জাহিদুল ইসলাম    রিতন     


        ---প্রথম পর্ব---

       সিগারেট ছ্যাঁকা লাগবার ভয় থকলেও ফুরিয়ে আসা সিগারেট-টায় জোরে টান মেরে রায়হান রশিদ সেটা অনিচ্ছার সঙ্গে ফেলে দিল মেঝেতে । অনেক্ষণ ধরে সে বসে রয়েছে এই বারটাতে । মাঝে মাঝে সে বিয়ারের গ্লাসে । পোড়া সিগারেটটা থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছিল সে পোড়া সিগারেটটার দিকে থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বারের আসনগুলো দিকে চোরা চাউনি হেনে একবার তাকিয়ে দেখলো । বার প্রায় খালি পড়ে আছে । কোণের দিকে দেয়ালের গা ঘেঁষে এক জোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা কথা বলতে বলতে মদের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছিল ।

    ওরা প্রেমিক-প্রেমিকা কিনা, আল্লাহই জানেন । প্রেমিকা একটু অন্যমনষ্ক হয়ে অন্য দিকে তাকাতেই প্রেমিক লাজুক চোখে তাকে দেখে নিয়ে চোখটা নামিয়ে নিচ্ছিল, রায়হান তা লক্ষ করছে ।
    এই জোলো সস্তা বিয়ার খেয়েই রায়হানকে এখন খুশী থাকতে হবে । পকেটে পয়সা কম । জুতোর তলা ফেঁসে গেসে, হাঁটলে ধুলোয় এতো ভরে যায় পা দুটো, পোশাক-পরিচ্ছদও এতো জীর্ণ হয়ে এসেছে যে রায়হানের ভয় হয়, সে হয়তো ভবিষ্যতে কোন কেসই পাবেনা ।
    রায়হান পেশায় একজন অসাধারণ প্রাইভেট ডিটেক্টিভ ।
    সে অসাধারণ, কেননা গোয়েন্দাগিরি করতে গিয়ে যে সব জটিল কেসে সে সাফল্য দেখিয়েছে, তার জন্য সহকারী গোয়েন্দা-মহলে সে ঈর্ষার পাত্র হয়ে উঠেছিলো এক সময় ।
    ইদানিং গোয়েন্দাগিরির বাজারে বেশ কিছু প্রতিযোগী দেখা দেওয়ায় তার পেশায় ভাঁটা পড়েছে । রায়হানের বিশ্বাস, আজ হোক আর কাল হোক, কেস তার হাতে আসবেই ।
    মাস-দুয়েকের মতন হাত গুটিয়ে বসে আছে সে এবং এই বারটেন্ডারের চ্যাপ্টা লাল নাকটার দিকে তাকিয়ে সস্তা জোলো বীয়ার খেয়ে সময় কাটাতে বাধ্য হচ্ছে ।
    সস্তা জোলো বিয়ার খেতে খেতে রায়হানের মনে পড়ে যুদ্ধের সময়ের কথা । যখন সে জাতিসংঘের হয়ে সোমালিয়ায় ডুবুরী বাহিনীর সঙ্গে ছিলো রাইয়হান ডুবুরীর সাজ-পোশাক পরে রাইনের গভীর  পানিতে একবার ডুব দিয়েছিল তারা । তারপর তীরে উঠে শেষ রাতের অন্ধকারে কাঁটা তারের বেড়া কেটে দিয়ে আবার পানির গভীরে ডুবে চলে এসেছিল নদীর অন্য পাড়ে । তখন তার বয়স আঠারো উনিশের মতন ।
    ...এবার রায়হান আর একটা সিগারেট ধরালো । না অতিতের কথা ভেবে সময় নষ্ট করে লাভ নেই । অফিস ফিরে গিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা করা যাক । একবছরের ভাড়া বাকী পড়ে আছে ওই অ্যাপার্টমেন্টের, বাড়ীউলী মিসেস আলী আজকাল আর খুব একটা সু-নজরে দেখে না তাকে, রায়হান তাকে যেমন ভাবে হোক এড়িয়ে চলে । এছাড়া পাওনাদারও তার জুটেছে অনেক । ইদানিং সিগারেটের দোকান থেকে শুরু করে হোটেল-রেস্তোরা সব জায়গাতেই তার ধার রয়েছে । এই সস্তা জোলো বিয়ার খাচ্ছে এটাও ধারে ।
    বারটেন্ডার রমেশ লোকটা খুব খারাপ নয় । বাড়ীউলী মিসেস আলীকেও খারাপ বলা চলে না । কিন্তু কত কাল আর বাংচিতে তাদের ঠান্ডা রাখা যেতে পারে ? ভাল মানুষেরও সহ্যের একটা সীমা আছে ।
    রাস্তায় নেমে এল রায়হান । সন্ধ্যা হতে আর বেশী বাকী নেই । বড় রাস্তার ভির ছেড়ে গলির ভেতর এসে, একবার চারদিকে তাকালো সে ।
    পাওনাদারদের ভয় তো আছে, সেই সঙ্গে মিসেস আলীর সঙ্গেও মুখোমুখি দেখা হবার ভয় রয়েছে । আর দুপা এগোলেই মিসেস আলীর সেই চারতলা বাদামী রঙের বাড়ীটা, যার তিন তলায় দুটি ঘর নিয়ে থাকে রায়হান । একটি ঘরে তার অফিস, অন্যটা তার থাকার ঘর ।
    ফুটপাত ছেড়ে বাড়ীটার পেছন দিক সরু প্যাসেজের দিকে পা বাড়ালো রায়হান ।
    এই খিড়কি দিয়েই কদিন হল সে লুকিয়ে লুকিয়ে তিন তলায় উঠে যাছে । খিড়কীর লোহার সিড়ি বেয়ে চোরের মতন, খুব সাবধানে, মিসেস আলী যেন টের না পান । রায়হান আজও তেমনি উঠলো ।
তারপর শোবার ঘরের কাছে এসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো রশিদ ।
    “না, কেউ দেখেনি আমায় । আর কেউ নেইও এদিকটায় । উঃ জুতোর তলা দিয়ে কি একটা ফুটল পায়ের তলাতে !”
    রায়হান জানালার কাঁচ তুলে ঢুকল ঘরের ভেতর । জুতুর তলা ফেঁসে গেসে । কে জানে, কবে তার এই “প্রাইভেট ডিটেকটিভ” অফিসে সত্যিকারের কোন ভালো কেস কোন ক্লাইন্ট আসবে কিনা !!!
একটু পর দোরের কড়া বেজে উঠল । পরিচারিকা ভেবে প্রথমে সাড়া দিল না রশিদ ।
আরো জোরে জোরে কড়া নাড়া শুরু হলো । বাধ্য হয়ে ড্রেসিং গাউনটা চড়িয়ে দরজা খুলে দিল গোয়েন্দা রশিদ ।
দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছেন মিসেস আলী । তাঁর দুচোখ ঠান্ডা, ঠোঁটে সামান্য হাসির রেখা ............... ।
“আমি তো বলেইছি, পরের মাসে সবভাড়া চুকিয়ে দেব আপনার!” রায়হান কাঁপা কাঁপা গলায় বলে। মিসেস আলী বলে উটলেন,“ভাড়ার জন্য আসিনি আমি ।“
একজন ক্লায়েন্ট এসে বসে আছেন আপনার অফিস ঘরে !
আপনি খিড়কী দিয়ে চুপিসারে এসেছেন বলে তাকে দেখতে পাননি এবং আমিও আপনাকে দেখিনি । সামনের সরজা দিয়েই আসা উচিৎ ছিল আপনার ।
রায়হান বলল, “আপনি সবই জানেন দেখছি ! তা সত্যিকারের রক্ত-মাংসের জীবন্ত ক্লায়েন্ট এসেছে তো ?”
মিসেস আলী হেসে বললেন , হ্যাঁ, জীবন্তই! একেবারে জীবন্ত একটা তাজা গোলাপের মতনই । এবার আপনি আমার ভাড়া চুকিয়ে দিতে পারবেন মনে হচ্ছে !”
রায়হানের বিষণ্ণ মুখে হাসির রেখা ছড়িয়ে পড়ল, “সত্যিই আপনাকে এখন অপরূপ সুশ্রী মনে হচ্ছে । এতটা বয়স হলেও মুখখানা আপনার লিলির মতন চমৎকার দেখাচ্ছে !”
“খুব হয়েছে !” হাসি চেপে ধমকে উঠলেন মিসেস আলী ।
“এ বয়সে আর ঠাট্টা ভালো লাগে না । কিন্তু ভাড়া দিতে ভুল যেন নায় ।“
মিসেস আলী গানের সুর ভাঁজতে ভাঁজতে চলে গেলেন নিচে নামবার সিড়ির দিকে ।
“......আমি যাকে খুঁজেছি তিনি কী আপনি ?” –সুরেলা মিষ্টি গলা । আর যার গলা থাকে স্বর ভেসে এল, তিনি অদ্ভুত সুন্দরী, এক রাশ কালো চুলের সুঠাম শরীরের তন্বী যুবতী । রূপ তার প্রতি অঙ্গে, হাল্কা নীল চোখে বুদ্ধির উজ্জলতা । অফিস গরে ঢুকেই রায়হান অবাক হয়ে তাকাল যুবতীর দিকে । সে কল্পনায় “রক্তমাংসের জীবন্ত ক্লায়রন্ট” হিসাবে একটি পুরুষকেই ভেবেছিল । এখন হঠাৎ এই সুন্দর পোষাকের যুবতীকে দেখে নিজের পোষাকের দৈন্য-দশার ক্তহা মনে পড়ে বেশ অস্বস্তি লাগল তার । তবুও মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, “বলুন--- মিস,মিসেস......”
“আপনিই কী ডিটেকটিভ রায়হান রশিদ ?”
“হ্যাঁ ।“
“অফিসে কী রোজই দেরী করে আসেন আপনি?।“
“না, মানে, একটা জুরুরী কেস ছিল । তাই ফিরতে একটু দেরী হয়েছে । “
রায়হান জানে, কথাটা ডাহা মিথ্যা বলেছে সে । এই তিন মাস ধরে শুধু বারটেন্ডার রমেশের ভ্রুকুটি সহ্য করা আর জোলো বীয়ার খাওয়া, পার্কে পার্কে ঘুরে বেড়ানো আর ঘরে এসে ক্রসওয়ার্ড পাজল করা ছাড়া আর কীই বা করেছে ?
যুদ্ধে, প্রেমে এবং কুটনীতিতে মিথ্যার প্রয়োজন আছে ।
একটা জীর্ণ চেয়ারে বসে পড়েছে যুবতী । কোলের উপর সুদৃশ্য ব্যাগ । বসে রায়হানের দিকে তাকিয়ে মৃদ হাসল । রায়হান বলল, “বলুন কী করতে পারি আপনার জন্য ?”
“মিঃ রশিদ, আমি আপনার সাহায্য চাই । “
টেবিলের উপরে পা তুলে দিয়ে দু হাত হাওয়ায় দুলিয়ে রায়হান বলল, “নিশ্চয়ই সাহায্য পাবেনকিন্তু সমস্যাটা কী, তাই বলুন ।।“ যুবতী কেমন অদ্ভুৎ চোখে তাকাচ্ছে তার জুতোর দিকে ।
আসলে তার জুতোর তলা দুটোই লক্ষ্য করছিল যুবতী । তার দুচোখে ফুটে উঠলো আশ্চর্য্য এক চাউনি ।
“আপনার ওই জুরুরী কেস্টার ব্যাপারে খুবুই হাঁটাহাঁটি করতে হচ্ছে আপনাকে ?” যুবতী প্রশ্ন করলো ।
ঝট করে পা দুটো নামিয়ে আনলো রায়হান । যুবতীর কথার ইঙ্গিত ভালো নয় । জুতোর তলা যে ফেঁসে গেছে ! রায়হান বললো, “আমি দুঃখিত । কাজের চাপে এতো ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম যে জুতো-জোড়া সারিয়ে নেবার কথা মনেই ছিলো না আমার ।“
যুবতী এবার উঠে পড়ল চেয়ার ছেড়ে । সঙ্গে সঙ্গে রায়হানের মনে হলো, যেন ফস্কে গেল ক্লায়েন্টটা । সে হতাশ চোখে তাকাল ।
“আমি এবার চলি । আপনি যাতে কিছুটা সময় পান এবং সেই সঙ্গে কিচু টাকা পান, তারই ব্যবস্তা করে যাচ্ছি আজ” 
রায়হান হ্যাঁ করে তাকিয়ে রইল ।
“তার মানে?”
ব্যাগ খুলে একতাড়া নোট বের করে যুবতী বলল, “পঞ্চাশ হাজার পেলে নিশ্চয় আপনি এই জঘন্য জায়গা থেকে সরে পরতে পারবেন ?”
“কী বলতে চাইছেন আপনি ?”
“আপনাকে এখন থেকে স্মার্ট হয়ে থাকতে হবে । টাকাটা নিন আর আজই বাজার গিয়ে দামী জামা-জুতো কিনুন ।”
“আমায় চিমটি কাটুন, আমি নিশ্চয় ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছি ।”
মৃদ হেসে যুবতী ব্যাগ থেকে সুতোয় বাঁধা ছোট্ট চাবি বের করে বলল, “এই চাবিটা রেখে দিন । এই হল আপনার নতুন গাড়ীর চাবি-যেটা আমি নীচে সদরের সামনে পার্ক করে রেখে এসেছি । গাড়ীটা আমি আপনার নামেই কিনেছি ! লাইসেন্সও আপনার নামেই আছে ।”    
“নিশ্চয় আপনি স্বর্গের কোনো পরী............নাকি আমার গড মাদার ?”
সুরেলা গলায় যুবতী হেসে উঠল । রায়হান হঠাৎ জেগে উঠল যেন । এতক্ষণের স্বপ্ন ভেঙ্গে গেছে । গম্ভীর এবং রুক্ষকন্ঠে বললো, “বুঝেছি, আপনি আমায় নিয়ে তামাসা করছেন । মজা করার জন্যেই এসেছেন !”
“---না না, আমি মোটেই তামাসা করছি না মিঃ রশিদ ।”
আপনার সমস্যাটা বললেন না তো ?”
“এই আমার কার্ড রইলো । সন্ধ্যের পরেই আপনি আমার বাড়ি যাবেন, সেখানেই কথাটা হবে ।”
“কোথায় আপনার বাড়ী ?”
“কার্ডেই রয়েছে ঠিকানাটা ।”
যুবতী এগিয়ে গেল দরজার দিকে । রায়হানও তার সঙ্গে নীচে নেমে এল । যুবতী রাস্তার ও-পাশে একটা গাড়ীতে গিয়ে উঠতেই গাড়ীটা স্টার্ট দিল । আর সদর দরজায় এসে আশ্চর্য হয়ে রায়হান দেখলো, হালফিল মডেলের ঝক ঝকে একটা শেভ্রলে গাড়ী দাঁড়িয়ে আছে সিঁড়ির কাছেই !    



Comments

Post a Comment