
---চতুর্থ পর্ব---
পরের
দিন ভোরে সে খবরের কাগজে খবরটা পড়ল ।
আইফেল টাওয়ারের উঁচু চূড়ো থেকে পড়ে গিয়ে অটো
বাগনার নামে একটা লোক মারা গেছে । খবরে বলা হয়েছে, বগনার এক ডিনারের নেমন্তন্ন
রাখতে আইফেলের ওই উঁচু রেস্তোঁরাতে গিয়েছিল । তখন রাত বেশ গভীর । বগনার হঠাৎ রেস্তোঁরার
বাইরে এসে রেলিং টপকে শূন্যে ঝাঁপ দিয়েছেন ও মারা গেছেন । মনে হয়, এটা একটা
আত্মহত্যার ঘটনা ।
কিন্তু
আমি বলবো, পেছন থেকে কেউ বগনারকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছে । মনে মনে বললো রায়হান ।
নাজীদের জমানো গুপ্তধনের শেয়ার থেকে একজন অংশীদার বাদ গেলে অন্যদের লাভ । তারাই
কেউ খুন করেছে ।
......মেরিলিন তাকে দেখে অবাক হয় । বলল, এতো
ভোরে ?”
হ্যাঁ, একটু তাড়াতাড়ি উঠলাম ! শোন, মেরিলিন,
আমি ঠিক করেছি লেক মুঞ্চেনের দিকে আমরা দুইজনেই রওনা হব । ওদের সঙ্গে যাব না ।”
কেন?” মেরিলিনের প্রশ্ন ।
“অটো বাগনারকে কেউ ধাক্কা মেরে ফেলে দিইয়েছে ,
সে মারা গেছে । আমি ভেবেছিলাম, এই বগনারই বোধহয় ‘কিং কোবরা’ । কিন্তু এখন দেখা
যাচ্ছে “কিং কোবরা” আড়াল থেকেই কাজ করে যাচ্ছে । এবং সে অটো বাগনারকে খুন করেছে ।”
রাস্তার
বাঁক পার হতেই থমকে দাঁড়াল রায়হান । ওদিকে ফুটপাতে একটা আলোর স্তম্ভের নীচে
দাঁড়িয়ে আছে কার্ল মাক এবং স্টোফার ।
মেরিলিনের হাত ধরে বাড়ীগুলোর পেছন দিকের গলিপথে
অদৃশ্য হয়ে গেল রায়হান।
ওদিকে
লাইট-পোস্টের নীচে দাঁড়িয়ে কব্জির ঘড়ির দিকে তাকিয়ে কার্ল মাক স্টোফারের
উদ্দ্যেশ্য বলছিল, ‘দেখুন! মেইনস্টেইনের ব্যাপারটা, এখনও এলেন না ! কী মতলব? বগনার
তো মরেই গেল--”
“আমার মনে হচ্ছে যেন-” মনে হচ্ছে, ও আমাদের
ফাঁকি দিয়ে সরে পড়েছে সীমান্ত অভিমুখে । চলুন আর দেরি নয়” । মাক এবং স্টোফার কালো
মার্সিডিজে স্টার্ট দিয়ে তীব্র বেগে গাড়ী ছুটিয়ে দিল সীমান্ত অভিমুখে । গাড়ী চলছে
দুধারে পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে । রায়হান ড্রাইভ করছে, পাশে মেরিলিন । খানিক্ষণ আগেই
ফরাসী সীমানা পার হয়ে এসেছে । জোৎসার আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারদিক ।
গাড়ী
আরও কিছুক্ষণ ছুটে চলার পর মেরিলিন হঠাৎ অস্ফুট একটা শব্দ করে উঠল । রায়হান চমকে
তাকাল সামনের দিকে । মেরিলিন বলল, ওই যে দেখো দূরে একটা ঝোপের পাশে কী যেন একটা
পরে আছে ।
“উঃ কি সর্বনাশ, এ যে একটা মানুষ !!” পাইনের বন
ছাড়িয়ে দূরে পাহাড়ের সারি চলে গেছে ব্যাভিরিয়্যার সুন্দর অরণ্যের দিকে । রায়হান
দ্রুত এগিয়ে গেল ঝোপের পাশে । সাদা চাদরে ঢাকা একটা মানুষ পড়ে আছে ঝপের ধারে ।
নিস্পন্দ নিথর একটা মানুষের লাশ ।
“আরে,
এ যে কার্ল মাক ! তাহলে সত্যিই ওরা আমাদের অনেক আগে চলে এসেছে ।”
“বেচে আছে কি মানুষটা ?”
“মরে গেছে ! মানে, কেউ মেরে ফেলে রেখে গেছে !”
মাক-কে খুন করল কে? “ মনে হচ্ছে, স্টোফারই
হত্যাকারী ! রাস্তার পাশে লেশটা এমন ভাবে রেখে গেছে যাতে আতঙ্কিত হ্যে আমরা ফিরে
চলে যাই । পল স্টোফার হয়তো ভেবেছে, মাকের মৃকদেহ দেখে ভয় পেয়ে হ্রদের দিকে না গিয়ে
আমরা ফিরে যাব প্যারিসে ।”
“আমার
বড্ড ভয় করছে রায়হান ।” বহুদূরে ব্যাভিরিয়ার ধূসর অরণ্য চোখে পড়েছে । তীব্রগতিতে
সেদিকে ছুটে চলল গাড়ী । মিউনিখ ওই অরণ্যের শেষে একটি শহর ।
পল স্টোফার হয়তো এতোক্ষণে পৌঁছে গেছে । লেক
মুনচেনের কাছাকাছি, লেকের গভীরে আছে গুপ্তধন ।
আর স্টোফার যদি হ্রদের কিনারে পৌঁছে গিয়ে থাকে,
তাহলে পানির তলা থেকে সিন্দুকটা তুলে নিয়ে গাড়ীতে উঠিয়ে পালিয়ে যেতে তার কোন বেগ
পেতেই হবেনা ।
কালো
মার্সিডিজটা ছায়া-ছায়া জোৎস্নার ভেতরে এসে দাঁড়ালো হ্রদের কিনারে ।
একটা নিশাচর পাখী উড়ে গেল মাথার উপর দিয়ে ।
শিশির ঝরে পড়ল তার ডানার গা বেয়ে । পল স্টোফার আকাশের চাঁদের দিকে চাইল ।
পল স্টোফার গাড়ী থেকে ডুবুরীর পোশাক, ও
সরঞ্জমাদি নামিয়ে নিল । তার শরীরে আধুনিক ডুবুরীর পোশাক, পিঠে অক্সিজেন নিলিন্ডার
ঝোলাল । হাতে লম্বা একগাছা দড়ি, সেই দড়ির এক প্রান্ত নিয়ে সে খুব শক্তকরে গাড়ীর
সামনের দিকটায় বেঁধে দিল । উদ্দেশ্য, পানির তলায় পৌঁছে সিন্দুকটায় বাঁধবে, তারপর
তীরে উঠে এসে গাড়ীতে গিয়ে বসে স্টার্ট দিয়ে সিন্দুকটাকে টেনে তুলবে উপরে ।
“হ্যা,
প্লান-মতন কাজটা করতে হবে” । ডুবুরীর মুখোশটা মাথায় লাগিয়ে গলিয়ে দিতে দিতে
স্টোফার আপন মনে বলে, প্রথমে পানির তলায় ডুবে নেমে যাব, তারপর দড়িটা বেঁধেদেব
সিন্দুকের সঙ্গে । তারপর.........তারপর...............”
হঠাৎ
বাধা পেল স্টোফার । কেউ যেন এসে দাঁড়িয়েছে তার পিছনে । একটা লম্বা ছায়া, তার প্রায়
ঘাড়ের উপর ছায়াটা ঝুঁকে পড়েছে ।
“এই
যে পল স্টোফার ! চুক্তির কথাটা ভুলে গেলেন ?” এতো তাড়াহুড়ো করে পানিতে নামছেন-অথচ
আমাদের কথা খেয়ালই হলো না ?”
পল
স্টোফার ঘাড় বেঁকিয়ে তকিয়ে দেখলো তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে রায়হান উরুফে মেইনস্টেইন,
পেছনে মেরিলিন । রায়হানের হাতে অটমেটিক লুগার ।
“কর্ণেল
মেইনস্টেইন আপনি ভুল করছেন । আমরা আপনার জন্যে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করছিলাম ।
আমার ধারণা ছিল, আপনি আমাদের সঙ্গেই আসবেন ।”
“কিন্তু
আপনাকে বিশ্বাস করতে পারিনি আমি । বগনারের ওই শোচনীয় মৃত্যুর পর থেকেই বিশ্বাসটা
টলে গিয়েছিল । তারপর রাস্তার পাশে ঝোপের ধারে কার্ল মাকের মৃতদেহ দেখে অবিশ্বাসটা
আরও দৃঢ হল । আপনি তাকে খুন করে ফেলে রেখে এসেছেন সেই ঝোপের ধেরে ।”
“কী
যা তা বলছেন আপনি ?”
“সত্যি কথাই বলছি ।”
স্টোফার বলল, “বগনারের মৃত্যুটা দূর্ঘটনা ছাড়া
অন্য কিছু নয় । কার্ল মাকও হঠাৎ হার্টফেল করে মারা পড়েছেন । অবশ্য তাকে আমি ওই
ভাবেই রাস্তার ধারে ফেলে এসেছিলাম । এটা হয়ত অন্যায় কিন্তু আমার তখন সময় ছিল না ।”
“সত্যি
কি তাই ?”
কার্ল মাক রাস্তায় আসতে আসতে হঠাৎ হার্ট
অ্যাটাক হয়ে মারা যান ।”
ভ্রুকুঞ্চিত
কিরে স্টোফার বলল, কিন্তু এখন কি করতে চান আপনি ?”
আমি
চাই, “আমরা দুজনেই পানির নীচে ডুব দিয়ে সিন্দুকটার খোঁজ করি ! মেরিলিন, গাড়ীর ভেতর
থেকে আমার ডুবুড়ীর সাজ-সরঞ্জামগুলো নিয়ে এসো !”
‘যাচ্ছি, রায়হান !’ –মেরিলিন বলল ।
অবাক
গলায় পল স্টোফার বলল, “রায়হান ? আপনি এই লোকটিকে রায়হান বলে ডাকলেন, ইনি তাহলে
আপনার স্বামী কর্ণেল মেইনস্টেইন নন ?”
মেরিলিন চুপ করে রইল ।
“কর্ণেল
ফ্রিজ মেইনস্টেইন এবং অটো বাগনারকে আপনি হত্যা করেছেন ?”
“তাহলে
তো কার্ল মাককেও আমিই হত্যা করেছি, নিশ্চয় কোন রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে ? কি
বলেন ?
আপনি
কে ? –প্রশ্ম পল স্টোফারের ।
“পরিচয় দেবার আগে আসুন নেমে পড়ি হ্রদের তলায় ।
ভল্র লোকের চুক্তি !”
পল
স্টোফার নীরবে শুনলো কথাগুলো । পরস্পরের প্রতি সন্দেহ আর আশঙ্কা নিয়ে দুটি মানুষ
ডুব দিল হ্রদের পানিতে । তীরে একটা পাইনের তলায় দাঁড়িয়ে রইল মেরিলিন, হাতে তার
লুগার । রাত ভোর হতে আর বেশী দেরি নেই । জোৎস্নার আলো তখনও হ্রদের পানিতে খেলা করে
বেড়াচ্ছে । রূপোর পাতের মতন ঝিকমিক করে হ্রদের নিস্তরঙ্গ পানি । নিশাচর পাখীরা
পাইনের পাতার আড়ালে থেকে শব্দ করে উঠছে ।
চলবে.....................
Comments
Post a Comment